কিভাবে নিজের প্রজেক্ট / থিসিস কে ডিফেন্ড করতে হয় ?

আমার প্রায় সাড়ে চার বছর শিক্ষকতা জীবনে অনেক ডিফেন্স বোর্ডে অংশ নিয়েছি। কখনও সুপারভাইজার হিসেবে, কখনও বা কোচ, কখনও বা দর্শক, কখনও ইন্টারনাল মেম্বার। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক মজার এবং হতাশাজনক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। যেমনঃ

  • একটা ছাত্র হয়ত অনেক ভাল একটা কাজ করেছে কিন্তু সে বুঝাতে পারছেনা।
  • সবসময়ই মনে হয় যে কি-পয়েন্ট গুলা সে মিস করে যাচ্ছে।
  • খুব ভাল একটা ছাত্র হয়ত বেঁধে যাচ্ছে বলতে গিয়ে।
  • একবার শুনেছি প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন বলে বসেছে “তার এই প্রজেক্ট নেওয়ার কারন সে আর কিছু পাচ্ছিলনা”
  • একজন একবার বলে বসল “সে অনেক কিছু চেষ্টা করে কিছু না পেরে একটা কিছু করে ফেলেছে আর কি” (এই গোপন কথা কি পরের কানে দেওয়ার কোনও দরকার আছে ????)
  • একজন এমন সব শব্দ স্লাইডে লিখে এনেছে যেটার মানেই সে জানেনা। এক্সটারনালের প্রশ্নে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে
  • পকেটে হাত ঢুকানো বারবার, কিংবা আম্মম্মম্ম আম্মম্মম্ম করতে থাকা মুখ দিয়ে অথবা আকাশের দিকে তাকিয়ে কবিতা চিন্তা করা ইত্যাদি মুদ্রা দোষ

আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি আমার সুপারভিশনে থাকা কোমলমতি শিশুদের শিখিয়ে দিতে কি করতে হবে, কি না। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা ভাল বলতে পারবে আমি কতটা সফল। প্রতিটা ল্যাব কোর্সে জোড় করে ভাইবা রেখেছি যাতে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা যায়। আমি নিজে কোনও ভাইবা অথবা ইন্টারভিউয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইনি। বরং ইন্টারভিউ বোর্ডে এমন পরিবেশ তৈরী করেছি যেন হাসাহাসি করা যায়। ভেজা কাপড়ে বুয়েটে প্রপোজাল দিয়েছিলাম, আন্ডারগ্র্যাড ডিফেন্সে ৪০ মিনিট হাসিমুখে প্রশ্নের উত্তর করেছি। আজ তাই কয়েকটি ট্রিক্স শেয়ার করব যাতে স্টুডেন্টরা নির্ভয়ে নিজেকে ডিফেন্ড করতে পারে। আশা করি কাজে আসবে।

  • বিক্রি করো নিজেকেঃ প্রথম পরামর্শ – নিজেকে বেচতে হবে। মার্কেটিং এর ছাত্ররা এটা খুব ভালো পারে। আনফরচুনেটলি আমরা যারা ইঞ্জিনিয়ারিং এর কামলা, তারা এটা কম পারি। কিন্তু তোমাকে তোমার বোর্ড মেম্বাররা কতটুকু চেনে। তুমি যেমনই হও না কেন, প্রমান করতে হবে তুমি “অসাম”। নিজে যতটুকু পারো সেটা কনফিডেন্টলি বলতে হবে। “স্যার আমি তো এটা দেখিনিন কখনও, এটা আবার কি” এবং “এই মুহূর্তে মনে পরছেনা তবে আমি এটা আমি জেনে নিব” এই দুই লাইনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য
  • ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা কি – জামা কাপড় একটা বড় ব্যাপার। এটাই প্রথম ইম্প্রেশন তৈরী করে। মানুষ কোনও ব্যাপারে মাইন্ড সেট করে ফেললে সেটা ভাঙ্গা কঠিন। সুতরাং, একটা রং চটা জামা পরে আসলে। এটা দেখেই মনে হবে এতো নিজেকে সামলাতেই পারেনা। তখন কাজ দিয়ে যতটা ইম্প্যাক্ট তৈরী করা যেত্, ততটা করা আরেকটু কঠিন হয়ে পরবে। ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং – গুড লুকিং রাস্কেলস লিডস দ্যা ওয়ার্ল্ড। সুন্দর দেখতে দুষ্টগুলাই দুনিয়া চালায়। মেড দ্যা ফার্স্ট ইম্প্রেশন। জামা কাপড় অনেকটা কনফিডেন্স বাড়ায়
  • যা করেছ সেটা সবসময়ই অনেকঃ হয়ত কোনও কারনে কাজটা একটু কম হয়ে গেছে। তুমি জানো। আমি জানি। আর কেউ জানে? তুমি নিজে জানানোর দরকার আছে? বলে বসলে “আমি তো একটা এভারেষ্ট বানাতে চেয়েছিলাম, পারিনাই। তাই একটা চেয়ার বানিয়েছি।” এটা বলে নিজেকে ছোট করার তো দরকার নেই। তুমি নিজের বেষ্ট দিয়েছ। সুতরাং, তোমার কাছে তো ওই চেয়ারটাই আপাতত এচিভমেন্ট। ছোট করে দেখার মত তো কিছু হয়নি। চেয়ার দিয়েই না হয় শুরু করেছ, কাল এভারেষ্ট বানাবে। সততার সাথে প্রেজেন্ট করবে কিন্তু নিজেকে ছোট করে নয়। চেয়ারটা বানাতেই তোমাকে রং পছন্দ করতে হয়েছে, উচ্চতা নির্ধারণ করতে হয়েছে। কোনটা আগে হবে, কোনটা পরে হবে এটা বাছতে হয়েছে। তোমার জন্য তো এগুলি প্রথম। জানাও কতটা কষ্ট করেছে। হোক না ছোট। তুমি তো প্রথম করেছ।
  • নিয়ম ফলো করি বা না করি জানি তোঃ একটা কমন মিস্টেক হল ভাইবার প্রশ্নে বলা যে আমি এই প্রজক্ট হঠাত করে বানিয়েছি। তোমাকে গুছিয়ে বলতে হবে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের যে লাইফ সাইকেল সেটা ব্যাখ্যা করতে হবে নিজের কাজ দিয়ে। কিভাবে আগে ফিচার চয়স করে নিয়েছ, তারপর ডিজাইনটা খসরা করে নিয়েছ, তারপর ইমপ্লিমেন্ট করেছ। আবার সুপারভাইজারের মতামত নিয়ে সেটাকে বদল করেছ। সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে হবে। এটা প্রকাশ করবে যে তুমি তোমার সিস্টেম জানো, তুমি সেটা গুছিয়ে বলতে পারো এবং ভবিষ্যৎ যে কোনও কাজ তুমি প্লান করেই করবে।
  • হাইলাইট ইয়োর পজিটিভসঃ বলার ধরনের কারনে অনেক সময় নিজের বড় প্লাস পয়েন্ট ঢাকা পরে যায়। যেমন ধরো তুমি হয়ত একটা মেইলিং সিস্টেম রেখেছ তোমার প্রজেক্টে। তুমি মুখে বলে গেলে “অব্জেক্টিভসঃ মেইলিং” আবার আরেকজন বলল “জিমেইন থেকে পপ-থ্রি এর মাধ্যমে একটা কার্যকরী নোটিফিকেশন সিস্টেম প্রভাইড করেছি যেটা ইউজার কিছু করলেই এডমিনকে মেইল করবে”। কোনটা ইম্প্যাক্টফুল শোনাচ্ছে ?????
  • যা জানিনা তা জানিনাঃ একটা প্রশ্ন করা হলে যদি আমতা আমতা করো তাহলে দর্শক হিসাবে মন ভেঙে যায় এবং কন্সেন্ট্রেশন চলে যায়। তার চেয়ে একটা বাক্যই যথেষ্ট “এটা আমি সঠিক জানিনা, জেনে নেব ভবিষ্যতে”। এটা কখনই তোমার দুর্বলতা প্রকাশ করেনা। একজন সব জানবে এমন নয়। বরং তোমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ভাল ধারনা প্রকাশ করে।
  • খুন করলেও সামনের স্যার সঠিকঃ মাঝে মাঝে যে আমরাও উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করিনা তা নয়। হয়ত সিস্টেম না বুঝেই একটা প্রশ্ন করে বসেছি। তুমি হয়ত জানো প্রশ্নটা বোকার মত হয়েছে, কিন্তু তর্ক করা যাবেনা। “স্যার আপনি কিচ্ছু বুঝেন নাই” এটা বলতে ইচ্ছা করবে কিন্তু বলা যাবেনা। বলতে হবে “স্যার এই মুহূর্তে আমরা এই টপিকটি যথাযথভাবে বুঝতে পারছিনা, তবে ভবিষ্যতে আমরা আরও বিস্তারিত জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব।
  • কি লাভ, কি লাভঃ তুমি যাই বানিয়ে থাকো না কেন। তার একটা ব্যবসায়িক দিক খুঁজে বের করতে হবে। অর্থাৎ প্রজেক্ট থেকে টাকা আয় হবে কিনা। হয়ত তুমি জানো এটা বিক্রি নয় শেখার জন্য বানানো। কিন্তু তোমাকে খুঁজে রাখতে হবে ব্যবসায়িক দিক কি কি হতে পারে। তোমার বেশিরভাগ দর্শকই হবেন ব্যবসায়ী কেউ। হয়ত সফটওয়ার ফার্মের মালিক কিংবা যিনি তোমাকে চাকুরী দিবেন। তিনি খুজবেন তুমি ব্যবসা বোঝো কিনা। কোনও লাভের আইডিয়া আদৌ চিন্তা করতে পারো কিনা। সুতরাং, বাচ্চাদের লার্নিং অ্যাপ বানানোর পর বলতে হবে “এটা বাচ্চার বাবা-মা কিনতে বাধ্য। নাহলে তাদের জীবন চলবেনা”
  • ভবিষ্যত পরে আছে, সব কিছু ভবিষ্যতে করবঃ হয়ত তোমার সুপারভাইজার, ইন্টারনাল, এক্সটারনাল মেম্বার এমন কিছু ফিচার বলবেন যেটা তুমি ভাবোনি, অথবা ভেবেছ কিছু সময় পাওনি। ৪-৬ মাস সব ফিচারের জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে। “ভুলে গেছি / মাথায় আসেনি”, এসব না বলে বলা উচিৎ “আমাদের ভবিষ্যত প্ল্যানে এটা যুক্ত করব”
  • একটা অচেনা শব্দ নয়ঃ স্লাইডে এমন কোনও শব্দ বা বাক্য লেখা যাবেনা যা তুমি চেননা। কিছু লিখে উত্তর করতে না পারার চেয়ে কম লিখে বুঝিয়ে দেওয়া উপযুক্ত।
  • ঘুম আমরা রাতে দেই, তোমার ঘুম পারানোর দরকার নেইঃ স্লাইডে প্যারাগ্রাফ লেখা এবং কারো মস্তিষ্কে ছুরিকাঘাত করা দুটোই সমান অপরাধ। যে শিক্ষক কিংবা ব্যক্তিকে ৫-১০ টি প্রজেক্টেক কাজ দেখতে হচ্ছে তার জন্য এটা খুবই বিরক্তিকর। স্লাইড এমন হতে হবে যেন আমাকে তোমার কথা মন দিয়ে শুনতে হয় বোঝার জন্য। সব স্লাইডে লিখে রাখলে তো কিছুই তোমার কথা আমার কানে আসবে না। আমার লক্ষ্য থাকবে স্লাইডটা পরা। সুতরাং স্বল্প কথায় পয়েন্ট করে স্লাইড বানাতে হবে। বাকিটা মুখে বলতে হবে।
  • এটিটিউডঃ কচ্ছপ কে দেখতে কেমন লাগে! একটা টগবগে ঘোড়া দেখতে কেমন লাগে। তুমি যদি স্লাইডের দিকে তাকিয়ে মুখস্ত কিছু বুল আওরাও সেটা তোমার ব্যর্থতা প্রকাশ করবে। কিন্তু যদি তুমি আডিয়েন্সের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের কথা বুঝাতে পারো তাহলে সেটা তোমার দক্ষতা প্রকাশ করবে। যদি তুমি ইংলিশে একটু দুর্বল হও, তাহলে সহজ ইংলিশেই বল। নিজের টেকনিক্যাল টার্ম গুলা মনে রাখো। আমি এমন ছাত্র দেখেছি যে ইংলিশে দুর্বল হয়েও বারবার বারবার বারবার বারবার প্রাক্টিস করে নিজের দুর্বলতা ঢেকে ফেলেছে। একটা উপায় তো খুঁজে বের করতেই হবে।

আশা করি, এই পরামর্শ গুলা কাজে আসবে। ফিল ফ্রি টু নক মি ইফ ইউ হ্যাভ এনি কোয়েশ্চেন্স। অল দ্যা বেষ্ট।

Atanu Shome
Faculty, CSE KU.

#ThinkAloud