আত্মহত্যার চিন্তার কোনও কমন ওষুধ হয়না

গত ১ সপ্তাহে আমার ফেসবুক ফিডে ২ টা সুইসাডের নিউজ এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন। আমি যদি ভুল না জেনে থাকি তবে একজন এমন পথ বেছে নিয়েছে প্রেমঘটিত কারণে। অন্যজন অর্থের অভাবে। অর্থের অভাবের সুইসাইড করা ছেলেটি গ্রামের বাড়ি গিয়ে টিউশনি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গ্রামে পেরে উঠছিলনা। প্রেমঘটিত কারণে সুইসাইডের ছেলেটির মাস্টার্সের ডিফেন্স বাকী ছিল শুধু। আর সব শেষ। প্রেমিকার শেষ ম্যাসেজ ছিল – বিয়ে করতে পারলে যোগাযোগ কোরো। এরপর ছেলেটি লিখে রেখে গেছে বাবা মাকে – আমার আর ভালও লাগছেনা বাচতে। আমার প্রিয় মানুষদের আমার মৃত্যুর খবর জানিও।

আমার ক্লাস যারা করেছে তারা জানে আমি এই ব্যাপারে কথা বলে থাকি ক্লাসে। প্রেমঘটিত কারণে সুইসাইড করার কথা ভাবলে আমার কাছে আসতে মানা করি। বাকীদের জন্য দরজা সবসময় খোলা ঘোষণা দেই। এক্সপার্ট না হলেও চেষ্টা অবশ্যই করব সমাধান দেওয়ার। সুইসাইডাল চিন্তা আসা খুবই স্বাভাবিক। ১০০% নরমাল আমাদের বর্তমান যুগে। নরমাল না হল ‘সেখান থেকে বের হওয়ার পথ দেখতে না পারা’। পরীক্ষার আগের রাতে খারাপ ফল নিশ্চিত ভেবে কি পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ করি আমরা। হাজারো সমাধান খুঁজে একটা একজিকিউট করি। আশা ধরে রাখি কিছু একটা হবেই। একদিন এই রাত শেষ হবেই।

আমাদের সময়ের এবং তার আগের জেনারেশনের এরকম সমস্যা ছিলনা। ছিল কিন্তু এত প্রখর না। স্কুলের স্যারের আদর খেয়ে কাঁদতে বসতাম না। ১০ মিনিট পর ভিডিও গেমের দোকানে নয়ত সার্কিট হাউসের মাঠে খেলতে নামতাম। আর আজকাল! স্যারের আদর খেয়ে নাকি মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে। এটা ওদের ব্যর্থতা নয়। ওদের দোষ নয়। দোষ আমাদের। এত জঘন্য পরিবেশ করে রেখেছি সমাজের যে ছেলে-মেয়ে কে বাচতে শেখাতে ভুলে গেছি। ওরা জানেই না বাচে কি করে তো করবেটা কি! মাস এক-দুই আগে একটা ছেলের গল্প শুনলাম। ছেলেটা ভার্সিটি টিচার। নিশ্চয় ফাইনানশিয়াল সমস্যা তার ছিলনা। তার প্রেমিকাও ছিল। পরবর্তীতে ফাঁস হয়ে যাওয়া চ্যাট থেকে জানা যায় সন্দেহের কারণে কিংবা ছোটখাটো বিষয়ে ঝগড়া লাগত। এবং এর থেকেই কোনও কারণ ছাড়াই সুইসাইড করেছে। দুঃখজনক ঘটনা এরপরের। তার কিছুদিন পর মেয়েটি সুইসাইড করেছে। বাংলাদেশের মানুষ। সাকিবের বাচ্চা মেয়েকে ফেসবুকে ছাড়েনা। ওই মেয়েটার কি অবস্থা করেছে তা ধারনা করাই যায়। মেয়েটির বাবা-মা কেন আচ করে সামলাতে পারলোনা সেটাই দুঃখ।



অনেকেই বলে আশেপাশের মানুষের দিকে লক্ষ্য রাখুন। দেখুন কার কি হচ্ছে। ডিপ্রেশনে গেছে কিনা। সুইসাইডাল থট আছে কিনা। এগুলা দায়সারা কথাবার্তা। একই রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার সময় ফেসবুকে মেতে থাকে, পাশের জনের দিকে তাকায় না, সেই জেনারেশন নাকি লক্ষ্য রাখবে আরেকজনের। বাচতে শিখতে হবে। নিজেকে নিজের বাচাতে হবে। ধরেই নিতে হবে এমন একদিন আসতেই পারে যেদিন আমারও মরতে ইচ্ছা করতে পারে। তখন কি করব। জানা থাকতে হবে। গত ৪-৫ মাসের ঘটনায় দেখেছি ১ দিনের ডিসিশনে কেউ মরেনা। ভাবে, উলটো পালটা লেখে ফেসবুকে, তারপর একদিন সীমা ছাড়িয়ে গেলে…… এইসময়টাতে যে সে মুক্তির উপায় ভাবতে পারেনি এটাই আমার হতাশা।

  • কোনোকিছুকে এতটা উপর নিওনা যে সেটা তোমার উপর চলে যায়। যার জন্য তোমার মরতে ইচ্ছা করবে সে তোমার উপযুক্ত না। অথবা হতে পারে দোষ তোমার তাতে মরার যুক্তি তো নেই। নিজেকে বদলানো যায়। সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়ে গেলে আবার শুরু করা যায়।
  • আমি প্রতিদিন এমন কিছু একটা করি যেটা আমাকে বিনোদন দেয়। এই মুহূর্তের জন্য আমার কারও দরকার পড়েনা। ওই সময়টা আমার। আর কারও না। কারও উপর ডিপেন্ডেন্সি এতটাও বাড়ানো উচিত না যে সে নিজের বাচার উপায় ভুলে যাবে। আমি হয়ত 9gag app এ ঢুকে র‍্যান্ডমলি মিমস দেখতে থাকি। নয়ত রাত ১ টায় গ্যাব্রিয়াল ইগ্লেসিয়াসের ৩০ মিনিটের একটা সেশন দেখে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাই। রাস্তায় নেমে মানুষ দেখে চিন্তা করি – ওই লোকটার কপালে ভাজ কেন! কি টেনশন চলছে তার জীবনে। নয়ত ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপটার ফোন রিসিভ করে কেলেঙ্কারি সব কাহিনী শুনি। অনেক হতাশ লাগলে পুরানো ঘোরার ছবি দেখে নতুন ঘোরার প্লান ভাবি। নয়ত TIFU সাবরেডিটে ঢুকে দেখি আজ কে কোন গাধার মত ঘটনা ঘটিয়েছে। মুভি সিরিজ চালিয়ে মাথা খালি করে হা করে তাকিয়ে থাকি। দেখি কি ঘটছে। এই সময়গুলি আমার। দিনের কোনও একটা সময় খুব খারাপ গেলেও এই মুহূর্ত কখনও খারাপ যায়না। আমার দিন একটা ঘটনার দাস না। অনেক মুহূর্তের সমষ্টি। তাতে কেউ বা কিছু আমাকে ছাপিয়ে নয়।
  • ইতিহাস বইটাও এতটাই ফালতু আমাদের। এক বোকা নবাবের পতনের গল্প শিখায়। কিন্তু কয়েকশ টাকা দিয়ে শুরু করা পোস্টারের ব্যবসা কিভাবে বিলিয়ন ডলার ব্যবসাতে কনভার্ট হল তা শিখায় না। এক স্বপ্ন ভেঙে গেলে আরেক স্বপ্নে কিভাবে যেতে হবে সেটা শিখায় না। আমরা শিখতাম এগুলা নাটক দেখে। নাট্যকাররা শিখাত। আজকাল নাটকে ছেলেদের কান্নাকাটি নয়ত গালি দেওয়া নয়ত রিভেঞ্জ নেওয়া শিখায়। অর্থের অভাবে ভেঙে পরলে যে চায়ের দোকান কিভাবে দেয় সেটা শিখায়না আমাদের কোনও বই। স্ট্রাগলের গল্প থাকেনা কোনও বইতে। তাই হয়ত এরা ভেবে পায়না। তখনই তো মরতে যায় যখন আর কোনও উপায়ই ভেবে পায়না।

এমন একটা যুগ যে নিজের সকল বিষয় আগে থেকে ভেবে রাখতে হবে। শান্তিতে বাচার মন্ত্র হল – নিজের সব এক্সিডেন্ট আগে থেকে ভেবে উপায় খুঁজে রাখা। তাহলে জীবনের আর কোনও ঘটনাই সারপ্রাইজ দেবেনা।

নিজের রোগের ওষুধ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। সুইসাইডাল চিন্তার কোনও কমন ওষুধ হয়না।

ভেঙে কি পরিনা! পরি! কিন্তু ছোটবেলার সেই দিনগুলি, সে বন্ধুগুলি, সেই মুহূর্ত গুলি, সেই স্যারদের আদরগুলি, পরিবারের কঠিন আদরগুলি আমাকে শিখিয়ে রেখেছে ভাল মুহূর্ত আসবেই একটু পরে। এটা কখনওই আমার মাথা থেকে যায়না।

অতনু সোম,
সিএসই, খুবি ।