Sreemangal Tour

শ্রীমঙ্গল ট্যুরের রিভিউ এবং ট্যুর প্লান

28-11-2020

প্রায় ৭ মাস করোনার জন্য ঘরে বন্দি থাকার পর মন ছুটে গিয়েছিল বটে কিন্তু মম-ড্যাডের কথা চিন্তা করে সাহস পাচ্ছিলাম না। অতঃপর শরীর জবাব দিয়ে দিয়েছে। সবকিছুতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল। তাই করোনা আমাকে হামলা করার আগেই আমার বডি যেন আমাকে মেরে না দেয় তাই ট্যুরের ডিসিশন নিলাম। নরমালি প্রায় এক মাস আগে থেকে ট্যুরের প্ল্যান করে থাকি। এবারও শুরু করেছিলাম কক্সবাজার এবং সেন্ট মারটিন দিয়ে। কিন্তু ঘটনা তো অন্য ঘটে গেল। বাসা ছেড়ে কোনও কালে বের না হওয়া ঘরকুনোরাও এবার করোনাকালে অতিষ্ট হয়ে সেন্ট মারটিন, কক্সবাজার এবং সাজেক গিয়েছে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া নিউমার্কেট (পড়ুন সাজেক) এবং ফ্রি জামাকাপড় বিতরণের লাইন (পড়ুন সেন্ট মারটিন জেটি) দেখে বুঝে গেলাম এসব জায়গায় আমি যে শান্তি চাই তা পাওয়া যাবেনা। তাই শ্রীমঙ্গল যাওয়ার ইচ্ছাটা এবার মিটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করলাম।
আমি একটু রিল্যাক্সে ট্রুর দেই। তাই আমার প্ল্যান একটু জিওগ্রাফিকাল পারস্পেক্টিভ থেকে শান্তি বেশি খোজে। ট্যুর হতে হবে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য, টুক করে দেখে কয়েকটা ছবি তোলার জন্য নয়। তাই নিচের এই প্ল্যানে কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ঢাকা থেকে গেলে একটি রিসোর্ট ঘুরে চলে আসতাম, কিন্তু আমাকে যেহেতু খুলনা থেকে যেতে হয় তাই আমার এক রিসোর্ট এ পোষাবে না। তাই দুইটা রিসোর্ট সিলেক্ট করা। একটি ToB এবং SSC-HSC গ্রুপের Top সাজেস্টেড রিসোর্ট Swiss Valley Resort এবং অন্যটি বৌ ও ইউটিউব ফেভারিট Novem Eco Resort . ঝামেলা হল অন্যখানে। এই কক্স-মারটিন থেকে ডিসিশন শ্রীমঙ্গলে আসতে আসতে ট্যুরের যে ডেট ঠিক করেছিলাম তাতে আর ৪ দিন বাকী ছিল। যার জন্য পছন্দসই ডেটে রুম বুক করা যাচ্ছিলোনা। যেটা অবশ্য পরে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

 

লোকাল ঘোরাঘুরিঃ
টার্গেট হচ্ছে কিছু জায়গা ঘুরব এবং রিসোর্টে রিল্যাক্স করব। ঢাকা থেকে রাতে একের পর এক বাস যায়। আমাদের বাস ছিল রাত ১০ টা ৪০ এ, কল্যাণপুর থেকে। গাবতলি কিংবা সায়েদাবাদ থেকেও যাওয়া যাবে। ভারা জন প্রতি ৩৮০ টাকা। বাস হানিফ। পৌঁছেছি সকাল ৫ টায় মৌলভীবাজারে। প্রশ্ন হল মোলভীবাজার কেন? কোনও কারণ নেই। আমাদের প্রথম থাকার জায়গা ছিল মোলভীবাজার। আপনি চাইলে শ্রীমঙ্গলে নেমে যেতে পারেন। প্রথমদিন ঘোরার জন্য বরাদ্দ। তাই এইদিন একটা সস্তা হোটেলে থাকাই ভাল। এদিন সারাদিন সন্ধ্যা আপনি বাইরেই থাকবেন। সুতরাং কি দরকার রিসোর্টে টাকা ঢালার। ৬ টায় চেক-ইন করে ৮ টায় বেড়িয়ে পরি। প্রথমেই যাই মোলভীবাজারের পানসী রেস্তোরায়। চিকেন খিচুরি। আঙ্গুল চাটার সময় আমাকে একটা ধন্যবাদ দিলেই হবে। তারপর পানসীর সামনে থেকে একটা টমটম ভারা নেই সারাদিনের জন্য। অটো ও বলা হয়ে থাকে এগুলাকে। এগুলা সিএনজি থেকে একটু স্লো। আপনি সিনএনজি ও ভারা নিতে পারেন। ৪ টা প্লেসের জন্য কন্ট্রাক্ট করি। লাউয়াছড়া, মাধবপুর লেক এন্ড টি এস্টেট, নূরজাহান টি এস্টেট, বাইক্কা বিল। বাইক্কা বিল যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিলনা। কারণ ওই যে – “আমি একটু রিল্যাক্সে ট্রুর দেই। তাই আমার প্ল্যান একটু জিওগ্রাফিকাল পারস্পেক্টিভ থেকে শান্তি বেশি খোজে”। একটা জায়গায় গিয়ে একটু দাড়াতে হবে, দেখতে হবে। হুড়োহুড়ি করা যাবেনা। আমাদের অটো ড্রাইভার আনাড়ি ছিল এবং তার ভুলের কারণে বেশ কিছু যায়গায় বেশি সময় নষ্ট হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাইক্কা বিল যেতেও পারিনি। আফসোস নেই যদিও। নেক্সট টাইম। সারাদিনে অটো ভারা ছিল ৯০০ টাকা। আবার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার পৌছে দিয়েছে। ড্রাইভার এর লাঞ্চ খরচ আলাদা। মাধবপুর লেক এবং টি এস্টেটেই আপনার চা বাগানের শখ পূরণ হয়ে যাবে। তাই ফিনলে এস্টেট যখন রাস্তায় দেখবেন তখন নামার দরকার নেই। ওগুলা প্রাইভেট প্রোপার্টি। ঢুকতে গেলে ঝামেলা করতে পারে।
বিকালে ফিরে একটু বসেই বের হলাম মৌলভীবাজার দেখতে। এত পরিষ্কার, এত সাজানো। র‍্যান্ডমলি হেটে, স্ট্রিট ফুড খেয়ে ডিনার করতে গেলাম পানসীতে। হাস খেয়ে টলতে টলতে রুমে ফিরেই ঘুম।

নভেম ইকো রিসোর্টঃ
পরদিন সকালে আবারও হেটে, ব্রেকফাস্ট করে সোজা চলে গেলাম আমাদের প্রথম রিসোর্ট (বৌ এবং ইউটিউব ফেবারিট) – নভেম ইকো রিসোর্টে। শ্রীমঙ্গল থেকে নভেমের ভাড়া সিএনজিতে নিয়েছে ১৫০। নভেম এর আর্কিটেকচার অদ্ভুত রকমের সুন্দর। আমরা নিয়েছিলাম mud cottage – ৪২০০ টাকা পার নাইট ফর টু পারসন (ডিস্কাউন্ট দিয়ে)। সাথে ছিল প্রাইভেট উঠান, যেখান থেকে আনারসের ক্ষেত দেখা যায়। মাড কটেজে ঘর মাটির তৈরি, আসবাবপত্রও মাটির। টয়লেট পাকা, ডোন্ট ওয়ারী 😀 পাহারের মাঝে আনারসের ক্ষেত দেখতে দেখতে নিজস্ব স্পেসে বসে গল্প করা এবং তার মাঝেই হঠাত কাঠবিড়ালির দেখা। অন্যরকম পরিবেশ। আর নভেমের স্ট্রাকচার তো আছেই। মাড কটেজ সিঁড়ি দিয়ে বেশ উপরে উঠে। সেখান থেকে নিচে তাকালে মনে হবে দুটি ছোট্ট পাহারের মাঝে সমতল ভূমি। চোখে না দেখলে বুঝানোর মত নয়। এখানকার বড়ও বৈশিষ্ট্য উড কটেজ উইথ প্রাইভেট পুল। আরও অসাধারণ। প্রাইস ও বেশি। বিস্তারিত পাওয়া যাবে ওদের ফেসবুক পেজে কিংবা ওয়েব সাইটে। তবে … নভেমের আসল রূপ এর রাতে। চারিদিক অসংখ্য সুন্দর লাইট দিয়ে সাজানো নভেম রাতে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগে। এদের সুইমিং পুল থেকে নীল রঙের লাইট বের হওয়া দেখলে মনে হবে এখানেই বসে থাকি কয়েক ঘণ্টা।
খাবার খরচঃ বেশ ভালই খরচ। ব্রেকফাস্ট কম্লিমেন্টারি। লুচি, ডাল, সবজী, চা, পাউরুটি জেলি, জুস, কলা। কিন্তু ইনফিনিটি। দেশি মুরগী ভুনা ২৫০, ব্রয়লার ভুনা ২০০, রুই মাছ (১ পিস) ৩০০ এরকম।
ভালদিকঃ নভেমের স্ট্রাকচার। ছবি তোলার জন্য আদর্শ। ডিফারেন্ট টাইপের রুম। প্রাইভেট পুল / প্রাইভেট লন। কমন পুল অসাধারণ পরিষ্কার।
খারাপ দিকঃ রেস্টুরেন্ট। এদের রেস্টুরেন্টের ম্যানাজমেন্ট খুব পারদর্শী না। খাবার খুবই স্ট্যান্ডার্ড এবং সেটাই সমস্যা। তেল মসলা এত কম যে আমার বাঙ্গালী পেটে পোষায় না। দামের কথা নাই বললাম। তবে একটু posh টাইপ রিসোর্ট হওয়ার কারণে দাম হয়ত যুক্তিসঙ্গত।

Novem Eco Resort
Sreemangal Tour (Novem Eco Resort)

সুইস ভ্যালী রিসোর্টঃ
১ দিন থেকে পরদিন চলে গেলাম সুইস ভ্যালী রিসোর্টে। নভেম থেকে বেশ দুরে। সিএঞ্জিতে আসতে হবে শমশেরনগর। ToB এবং SSC-HSC গ্রুপের অন্যতম ফেভারিট। গিয়ে তো চমকে গিয়েছি। এটা আমার এক্সপেকটেশন থেকে ভাল বেরিয়েছে। যাওয়ার ২ ঘণ্টার মধ্যে আরেকদিন এক্সটেন্ড করেছি। প্রথমদিন নন-এসি রুমে ছিলাম, পরদিন এসি। নন-এসি ১৯৫০ টাকা ডিস্কাউন্ট দিয়ে, এসি রুম ৩০০০ টাকা ডিস্কাউন্ট দিয়ে। ট্যুরে আসার মাত্র ৪ দিন আগে বুক করার জন্য এটা পরে নিতে হয়েছে। নাহলে ইচ্ছা ছিল নভেম শেষে নেওয়ার। কিন্তু এখানে আসার পর মনে হয়েছে ভাগ্যিস এটা পরে নেওয়া হয়েছে। নাহলে এক্সটেন্ড করতে পারতাম না। এত সুন্দর রিসোর্ট। জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং। প্রতি ৩-৪ হাত এগিয়ে গেলে নতুন কিছু একটা চোখে পর্বে। নতুন কাঠের সাজানো শৈল্পিক কোনও স্ট্রাকচার, কিংবা নতুন কোনও গাছ যা জীবনে দেখিনি, নয়ত নতুন কোনও ফুল। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। পাশে আবার একটু ছোট্ট পুকুরও আছে। দোলনা, উঁচু টিলার উপর বসার জায়গা, বিশাল এক সুইমিং পুল। কি নেই!! I loved this one.
খাবারের দাম: এদের খাবার প্যকেজ সিস্টেম। ২০০-৪০০ টাকার প্যাকেজ। বুকিং এর দিনেই মেইলে জানিয়ে দেবে প্যাকেজ সম্পর্কে। উদাহরন স্বরূপঃ (ভাত, ডাল, ভর্তা, সবজী, সালাদ, হাস/দেশী চিকেন কারী) = ৪০০। (ভাত, ভরতা, চাটনী/পাকোরা, সবজী, ডাল) = ২০০। এমন আরও অনেক। চিকেন গ্রিল, ফিস গ্রিলও আছে। ২ জনের জন্যও করে দেয়। ৪০০ টাকা এবং ৩৫০ টাকা। আমি প্রতি বেলায় তিন বেলার সমান খেয়েছি। যে পরিমাণে ২ জনের জন্য দেয় তাতে ৪ জন খেতে পারবে। ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টরী। খিচুরি, ডিম, পিয়াজ ভরতা অথবা পরোটা, vaji, ডাল, ডিম। এবং সাথে চা।
ভালোদিকঃ সব।
খারাপ দিকঃ আমার কিচ্ছু খারাপ লাগেনাই।

Swiss Valley Resort
Sreemangal Tour (Swiss Valley Resort)

শেষ হইয়াও হইল না শেষঃ
অতঃপর ট্যুর শেষ করে শ্রীমঙ্গল এলাম। আবারও শ্রীমঙ্গলের পানসীতে আস্ত কোয়েল গিলে হানিফে চড়ে ঢাকা। ১ ঘণ্টা পরপর বাস পাওয়া যায়। এই বাস দিনের বেলায় নেওয়ার কারণে আমাদের ট্যুর আসলে শেষ হয়নি। এই রাস্তা নিজেই একটা ট্যুরিস্ট স্পট। হবিগঞ্জের র‍্যান্ডম টি এস্টেট, শ্রীমঙ্গল statue , উঁচু নিচু রাস্তা – সবমিলিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি। আবার যাবো শ্রীমঙ্গল।

শ্রীমঙ্গল সম্পর্কে একটি দুঃখের অনুভূতিঃ
এখানকার সাধারণ মানুষ খুব ভাল। নিজে থেকে এসে কথা বলছিল। কিছু জিজ্ঞেস করলে সাহায্য করছিল। কিন্তু দুইটা সমস্যাও ছিল। প্রথমটিঃ প্রচুর ভিক্ষুক। এবং গায়ে পরা টাইপ। একটার পর একটা এসে ডিস্টার্ব করে রাস্তায়, রেস্টুরেন্টের বাইরে। দ্বিতীয় সমস্যা ট্যুরিস্ট এলাকার বাটপার। যেমনঃ মাধবপুর লেকে গাইডের নামে কিছু বাটপার আছে। শুধু শুধু পিছু নিয়েছে। টের পেয়ে আগেই জানিয়েছি গাইড লাগবেনা। তখন বলে মামা চা খাওয়ার জন্য তাহলে কিছু দেন। গায়ে পরা স্বভাবের। আবার অটো চালক বারবার স্পটে যেয়ে পান খাবো, চা খাবো বলে কিছু দাবী করছিল। জায়গা চেনেনা কিন্তু চেনে বলে আমাদের উঠিয়ে ভুল রাস্তায় নিয়ে গেছিল। গুগল ম্যাপ দেখে রক্ষা পেয়েছি।

৪ নাইট , ৫ দিনের মোট খরচ = ২৪২৮৩ টাকা – ২জন। ৪ টি হাফ কেজির চা প্যাকেটের দাম সহ, খুলনা থেকে ঢাকা যাতায়াত এবং ঢাকাতে দুই বেলা খাওয়া সহ। চা কিনেছি শ্রীমঙ্গলের গুপ্ত টি হাউজ থেকে। কেউ কিনে ধরা খেলে গালির দাবীদার হবে এক ইউটিউবার। অবশ্যই খরচ বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু এটি একটি হাসবেন্ড ওয়াইফ রিল্যাক্স মার্কা ট্যুর।

 

Atanu Shome

CSE, KU.